ঢাকা,  বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ,

পানির তোড়ে রেললাইন বাঁকা হয় কখন

মতামত

নাহিদ হাসান

প্রকাশিত: ১৩:৫০, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

আপডেট: ১৪:১৭, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

পানির তোড়ে রেললাইন বাঁকা হয় কখন

সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের তেমুহনী এলাকা। এই এলাকার ওপর দিয়ে গেছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন। এখানে প্রায় ১০ হাজার মানুষের বসবাস। ফেসবুকে সাদিয়া জেরিন পিয়া লিখেছেন, এতদিন জানতাম, লোহা উচ্চতাপে গলানো ও বাঁকানো যায় এবং রেললাইন ভূমিকম্প, দাবানল বা উচ্চমাত্রার তাপে আঁকাবাঁকা হয়ে যায়। কিন্তু পাহাড়ি ঢলের পানির নীচে বা পানির তোড়ে রেললাইন এইরকম ঢেউ খেলে যায় জীবনে প্রথম দেখলাম!

আগস্টের ১১ তারিখ সকালে প্রথমআলোর প্রতিনিধি সুজন ঘোষ সরেজমিনে দেখা পান, বন্যার পানিতে ঘর ভেসে যাওয়া মানুষেরা আশ্রয় নিয়েছেন রেললাইনের ওপর। তাঁরা তাঁবু টানিয়ে সেখানে পরিবার নিয়ে আছেন গত বুধবার থেকে।

তাঁদের একজন নূর মোহাম্মদ। রেললাইনের ওপর তাঁর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র শুকাতে দিয়েছেন। দুই সন্তানের জনক পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি এই ব্যক্তি বলেন, বন্যার পানিতে তাঁদের ঘর ভেঙে গেছে। তাই রেললাইনের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন।

সাবেক ইউপি সদস্য আবদুস শুক্কুর বলেন, ১৯৯৭ ও ২০১৯ সালেও তাঁদের এলাকায় বন্যা হয়েছিল। তবে তা এত ভয়াবহ ছিল না। এবার অন্তত তিন-চার হাত পানি বেশি হয়েছে। রেললাইনের কারণে তাঁদের এলাকা পানিতে ডুবেছে।

সিএনজিচালক মোহাম্মদ হোসাইন (৪৩) বলেন, তাঁদের এলাকায় রেললাইনে চারটি মাত্র কালভার্ট দেওয়া হয়েছে। শুরুতে আরও কম ছিল। তাঁরা আন্দোলন করলে কালভার্ট বাড়ানো হয়। আরও যদি বাড়ানো হতো, তাহলে এই সর্বনাশ হতো না। ভবিষ্যতেও এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহনবিশেষজ্ঞ এম শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে ছোট ছোট কালভার্ট রাখা হয়েছে। কিন্তু তা পানিনিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এই অঞ্চল দিয়ে পাহাড়ি এলাকার ঢল দ্রুত নেমে এসে সাগরে গিয়ে পড়ে। পানিনিষ্কাশনের পথে রেললাইনের মাধ্যমে বাঁধ দেওয়ায় পানি নামতে পারেনি। যেহেতু রেললাইন হয়ে গেছে, তাতে সংশোধনের তেমন কোনো সুযোগ নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন এ ধরনের বৃষ্টি আরও হবে। তখন রেললাইন আবার ডুববে। এতে স্বাভাবিকভাবই মানুষ প্রশ্ন তুলবেন রেলওয়ে পরিকল্পিতভাবে রেললাইন নির্মাণ করেনি।

২.

সাহেবদের চোখে দামোদর বাংলার দুঃখের নদী, কারণ বন্যা হলে রাজস্ব সংগ্রহ করা যায় না, জিটি রোড বিচ্ছিন্ন হলে যোগাযোগ ব্যাহত হয়। ১৯৫৫ সালে হাওড়া থেকে রাণীগঞ্জ পর্যন্ত উঁচু বাঁধের উপর দিয়ে রেলপথ নির্মিত হলো, যাতে বন্যার জলে লাইন না ডুবে যায়; বাঁধের মাটি নেওয়া হল লাইনের ধার বরাবর গর্ত করে। কিন্তু রেললাইন নির্মাণের পর বন্যার প্রকোপ বাড়ল, ম্যালেরিয়া মহামারি হয়ে দেখা দিল, কৃষি উৎপাদন কমে গেল।
এ প্রসঙ্গে ১৯০৭ সালে ইণ্ডিয়ান মিরর পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, রেললাইনকে বন্যা থেকে বাঁচানোর জন্য দামোদরের পূর্ব পাড় বরাবর বাঁধ দেওয়ার বর্ধমান ও হুগলি জেলার জলাভূমি ও দীঘিগুলি মজে যায়। কারণ বন্যার জলে ওই জলাশয়গুলি প্রতি বছর পুনরুজ্জীবিত হতো। এরপরই ওই দুই জেলায় দেখা দিল দুর্ভিক্ষ, অনাহার ও ম্যালেরিয়ার মহামারি।

মেঘনাদ সাহা ১৯৩৩ সালে এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, 'পৃথিবীতে ন্যায় বিচার বলে যদি কিছু থাকে বর্ধমান ও হুগলি জেলার নাগরিকরা এই ক্ষতির জন্য রেলের কাছে ক্ষতিপূরণ পেতে পারে।' ১৯১৭ সালে একইভাবে তৈরি হল হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইন। ফলে আবার রুদ্ধ হল বন্যার জলের নিকাশি পথ। 'বাংলার নিজস্ব সেচব্যবস্থা' বইয়ের ভূমিকায় এই কথাগুলো বলেছেন কল্যাণ রুদ্র।  কিন্তু গল্পগুলো এখনও একই।

৩.

নদী আসলে দুই প্রকার। ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, পদ্মা, তিস্তা, ভৈরবেট মত নদীগুলো হলো পরিবহন নদী। আর যে নদীগুলোতে পরিবহন সম্ভব হয় না, সেগুলো সেচনদী। সাধারণ সেচনদী গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত পরিবহন নদীর পানি বহন করে। কিন্তু বাংলার প্লাবন নদীগুলো কাজ করত ভিন্ন এক পরিস্থিতিতে। মূলত সেচ হত বৃষ্টির পানি দিয়ে। নদীর পানি ব্যবহৃত হত বৃষ্টির পানিকে সারবান করে তোলা এবং মশা নিধন ও তাদের ক্ষতিকারিতা নষ্ট করার জন্য। উইলিয়াম উইলকক্স ১৯৩৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতায় বলেছেন, দুইশ বছরের অবহেলায় এই সেচনদীগুলোকে আবার ভরে যেতে দেওয়া হয়েছে। যে কারো অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়বে, জলপ্রবাহের মাধ্যমে তৈরি হওয়া নদীগুলোর খাত অনির্দিষ্ট বা এলোমেলো নয়। বরং বছরে বছরে যেমন করে তা সরে যাওয়ার বদলে সবসময়ই নির্দিষ্ট স্থানেই এই প্রবাহের মুখ উন্মুক্ত হয়ে যায়।

দামোদর বাঁধ, রেল লাইন, জিটি রোড এবং ইডেন খালের বাঁধ হল শয়তানের শৃঙ্খল, যা নিম্ন দামোদর অববাহিকাকে নদীর জল ও পলি থেকে বঞ্চিত করেছে। কথাগুলো উইলিয়াম উইলকক্স এর। যাদের কারণে ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকার প্রকল্প সংশোধিত ব্যয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকায় প্রা-য়-ই শেষ হওয়ার পর আগুনের বদলে পানিতে লোহা বেঁকে যায়, তাদের শয়তান বলার সাহসও আমাদের নেই।

নাহিদ হাসান: গণবুদ্ধিজীবি
nahidknowledge1@gmail.com